ব্যবসা হলো সকল বৈধ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সমষ্টি, যার মাধ্যমে মানুষ মুনাফা অর্জনের জন্য পণ্য বা সেবা উৎপাদন,বণ্টন ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল কাজে ব্যস্ত থাকে। যখন নির্দিষ্ট দেশের সীমানার মধ্যে এই ব্যবসায়িক কর্মকান্ড সংগঠিত হয়, তখন তাকে অভ্যন্তরীণ ব্যবসা বলে। অন্য দিকে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ের মাধ্যমে এক দেশের সাথে অন্যদেশের পণ্য বা সেবার উৎপাদন ও বণ্টনের সাথে সম্পর্কযুক্ত সকল ব্যবসায়িক কাজ সম্পাদিত হয়।
আন্তর্জাতিক ব্যবসা বলতে পণ্য, পরিষেবা, প্রযুক্তি, মূলধন এবং/অথবা জ্ঞানের জাতীয়/দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী বা আন্তঃজাতিক পরিমন্ডলে বাণিজ্যকে বোঝায়।
এতে দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে পণ্য ও পরিষেবার আন্তঃসীমান্ত লেনদেন জড়িত। অর্থনৈতিক সম্পদের লেনদেনের মধ্যে রয়েছে পুঁজি, দক্ষতা এবং মানুষের আন্তর্জাতিক উৎপাদনের উদ্দেশ্যে ভৌত পণ্য এবং পরিষেবা যেমন অর্থ, ব্যাংকিং, বীমা এবং নির্মাণ। আন্তর্জাতিক ব্যবসা বিশ্বায়ন নামেও পরিচিত।
বিদেশে ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য, বহুজাতিক কোম্পানিগুলিকে আলাদা জাতীয় বাজারগুলিকে একটি বিশ্বব্যাপী বাজারে পরিণত করতে হবে। দুটি ম্যাক্রো-স্কেল ফ্যাক্টর রয়েছে যা বৃহত্তর বিশ্বায়নের প্রবণতাকে আন্ডারলাইন করে। প্রথমটিতে রয়েছে আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যকে সহজ করার জন্য বাধা দূর করা (যেমন, পণ্য ও পরিষেবার অবাধ প্রবাহ এবং মূলধন, যাকে “মুক্ত বাণিজ্য” বলা হয়)। দ্বিতীয়টি হল প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, বিশেষ করে যোগাযোগ, তথ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং পরিবহন প্রযুক্তির উন্নয়ন।
“আন্তর্জাতিক ব্যবসা” বহুজাতিক উদ্যোগের আন্তর্জাতিকীকরণ প্রক্রিয়ার অধ্যয়ন হিসাবেও সংজ্ঞায়িত। একটি বহুজাতিক এন্টারপ্রাইজ (MNE) হল এমন একটি কোম্পানী যার বিভিন্ন দেশে বাজার, উৎপাদন অথবা ক্রিয়াকলাপের জন্য বিশ্বব্যাপী দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। সুপরিচিত MNE-এর মধ্যে রয়েছে ফাস্ট-ফুড কোম্পানি যেমন: McDonald’s (MCD), YUM (YUM), Starbucks Coffee Company (SBUX), Microsoft (MSFT), ইত্যাদি এবং জেনারেল মোটরস (GMC)। কিছু ভোক্তা ইলেকট্রনিক্স উৎপাদক যেমন Samsung, LG এবং Sony, এবং শক্তি কোম্পানি যেমন Exxon Mobil, এবং British Petroleum (BP) এছাড়াও বহুজাতিক উদ্যোগ।
বহুজাতিক এন্টারপ্রাইজগুলি যেকোন ধরণের ব্যবসায়িক কার্যকলাপ বা বাজার থেকে শুরু করে, ভোগ্যপণ্য থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি তৈরি পর্যন্ত; একটি কোম্পানি একটি আন্তর্জাতিক ব্যবসা হতে পারে. তাই, বিদেশে ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য, কোম্পানিগুলিকে এমন সমস্ত কারণ সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত যা ব্যবসায়িক ক্রিয়াকলাপগুলিকে প্রভাবিত করতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে; আইনি ব্যবস্থার পার্থক্য, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক নীতি, ভাষা, অ্যাকাউন্টিং মান, শ্রমের মান, জীবনযাত্রার মান , পরিবেশগত মান, স্থানীয় সংস্কৃতি, কর্পোরেট সংস্কৃতি, বিদেশী-বিনিময় বাজার, শুল্ক, আমদানি ও রপ্তানি প্রবিধান, বাণিজ্য চুক্তি, জলবায়ু, এবং শিক্ষা। এই কারণগুলির প্রতিটির জন্য কোম্পানিগুলি কীভাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে কাজ করে তাতে পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে। প্রতিটি ফ্যাক্টর একটি পার্থক্য এবং একটি সংযোগ করে।
বহুজাতিক কোম্পানির তত্ত্বের বিকাশে নিযুক্ত প্রথম পণ্ডিতদের মধ্যে একজন ছিলেন কানাডিয়ান অর্থনীতিবিদ স্টিফেন হাইমার। তার শিক্ষাজীবন জুড়ে, তিনি তত্ত্বগুলি তৈরি করেছিলেন যা বিদেশী সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিল এবং কেন সংস্থাগুলি বহুজাতিক হয়ে ওঠে।
হাইমারের কাজ অনুসারে আন্তর্জাতিকীকরণের তিনটি পর্যায় ছিল। হাইমারের কাজের প্রথম পর্যায়টি ছিল 1960 সালে তার গবেষণামূলক প্রবন্ধ যাকে বলা হয় জাতীয় সংস্থার আন্তর্জাতিক অপারেশন। এই থিসিসে, লেখক নিওক্ল্যাসিকাল তত্ত্ব থেকে প্রস্থান করেন এবং আন্তর্জাতিক উত্পাদনের একটি নতুন ক্ষেত্র উন্মুক্ত করেন। প্রথমে, হাইমার নিওক্লাসিক্যাল তত্ত্ব এবং আর্থিক বিনিয়োগ বিশ্লেষণ শুরু করেন, যেখানে মূলধন আন্দোলনের প্রধান কারণ হল সুদের হারের পার্থক্য। এই বিশ্লেষণের পর, হাইমার উৎপাদন এবং সরাসরি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বড় কোম্পানির বিদেশী বিনিয়োগের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করেন, এই বিদেশী সরাসরি বিনিয়োগ (FDI) নামে অভিহিত করেন। দুই ধরনের বিনিয়োগ বিশ্লেষণ করে, হাইমার আর্থিক বিনিয়োগকে প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ থেকে আলাদা করেছেন। প্রধান স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল নিয়ন্ত্রণ। পোর্টফোলিও বিনিয়োগ হল আরও প্যাসিভ পন্থা, এবং মূল উদ্দেশ্য হল আর্থিক লাভ, যেখানে বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগে একটি ফার্ম বিদেশের কার্যক্রমের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখে। সুতরাং, ডিফারেনশিয়াল সুদের হারের উপর ভিত্তি করে বিনিয়োগের ঐতিহ্যগত তত্ত্ব FDI-এর প্রেরণা ব্যাখ্যা করে না।
হাইমারের মতে, FDI এর দুটি প্রধান নির্ধারক আছে; যেখানে একটি অপূর্ণ বাজার কাঠামো মূল উপাদান। প্রথমটি হল দৃঢ়-নির্দিষ্ট সুবিধা যা নির্দিষ্ট কোম্পানীর দেশে তৈরি করা হয় এবং লাভজনকভাবে, বিদেশে ব্যবহৃত হয়। দ্বিতীয় নির্ধারক হল নিয়ন্ত্রণ অপসারণ যেখানে হাইমার লিখেছেন: “যখন সংস্থাগুলি পরস্পর সংযুক্ত থাকে, তখন তারা একই বাজারে বিক্রি করতে প্রতিযোগিতা করে বা একটি সংস্থা অন্যটির কাছে বিক্রি করতে পারে” এবং এর কারণে “কেন্দ্রীভূত প্রতিস্থাপন করা লাভজনক হতে পারে বিকেন্দ্রীভূত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ।”
হাইমারের দ্বিতীয় পর্ব হল 1968 সালে তার নিওক্লাসিক্যাল প্রবন্ধ যা আন্তর্জাতিকীকরণের একটি তত্ত্ব অন্তর্ভুক্ত করে এবং সংস্থাগুলির আন্তর্জাতিক সম্প্রসারণের বৃদ্ধির দিক ব্যাখ্যা করে। পরবর্তী পর্যায়ে, হাইমার আরও মার্কসবাদী পদ্ধতিতে গিয়েছিলেন যেখানে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে MNC একটি আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এজেন্ট হিসাবে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে, যা বিশ্বের অন্যান্য জিনিসের মধ্যে অসমতা এবং দারিদ্র্যের কারণ হয়। হাইমার হল “MNEs তত্ত্বের জনক” এবং বিদেশে সরাসরি ব্যবসা করার জন্য কোম্পানিগুলির প্রেরণা ব্যাখ্যা করে৷
বহুজাতিক এবং বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের আধুনিক অর্থনৈতিক তত্ত্বগুলির মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণকরণ তত্ত্ব এবং জন ডানিংয়ের OLI দৃষ্টান্ত (মালিকানা, অবস্থান এবং আন্তর্জাতিকীকরণের জন্য দাঁড়িয়েছে)। ডানিং আন্তর্জাতিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ এবং বহুজাতিক উদ্যোগের অর্থনীতিতে গবেষণার জন্য ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন। তার ওএলআই দৃষ্টান্ত, বিশেষ করে, আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক বিষয়গুলি অধ্যয়নের জন্য প্রধান তাত্ত্বিক অবদান হিসাবে রয়ে গেছে। হাইমার এবং ডানিংকে অধ্যয়নের বিশেষজ্ঞ ক্ষেত্র হিসাবে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
প্রাচীনকাল থেকেই ইউরোপের বণিকরা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে কলোনিস্থাপন করে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে। ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের পর চলমান আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রকৃতি পরিবর্তন হয়, গতি ও আওতা বৃদ্ধি পায়। মূলত তখন হতেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নতুন নতুন প্রয়োজনীয় পণ্য ও উৎপাদন কৌশল আদান-প্রদানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রসার ঘটে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অর্থনীতির বিশ্বায়ন ও দেশ গুলোর মধ্যে বিভিন্নতা ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে একদিকে যেমন প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করে, অন্যদিকে সম্ভাবনাও তৈরি করে। আন্তর্জাতিক ব্যবসায় তরান্বিত করার ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে পণ্য বা সেবার বিনিময় কার্যক্রমকে আন্তর্জাতিক ব্যবসা বলে। ভোক্তা,উৎপাদনকারী ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। আন্তর্জাতিক ব্যবসায় পরিচালনা এবং কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক পরিবেশ পর্যালোচনা করা আবশ্যক। আন্তর্জাতিক ব্যবসা সংক্রান্ত জ্ঞান, ব্যবসা পরিচালকদের মধ্যে নমনীয়তা, অভিযোজন যোগ্যতা, আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ ও সম্পর্ক তৈরির মতো মনোভাব ও দক্ষতা তৈরি করে, যা বৈশ্বিক ব্যবসায়িক পরিবেশে তাদের সাফল্যকে বাড়িয়ে তোলে।
বিশ্বায়ন(Globalization)
কয়েক দশক ধরে বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি মৌলিক পরিবর্তন ঘটছে। আমরা এমন এক বিশ্ব থেকে সরে যাচ্ছি, যেখানে জাতীয় অর্থনীতি গুলো অপেক্ষাকৃত স্বংসম্পূর্ণ ছিল। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন আন্তঃসীমান্ত গুলো বাণিজ্যের প্রতিবন্ধকতা,দূরত্ব, সময়, অঞ্চল ভাষা, সংস্কৃতি, সরকারি নিয়ন্ত্রণ, ব্যবসা ব্যবস্থা দ্বারা একে অপরের থেকে বিছিন্ন ছিল। এখন আমরা এমন একটি বিশ্বের দিকে অগ্রসর হচ্ছি, যেখানে সীমান্ত বাণিজ্য ও প্রতিবন্ধকতা হ্রাস পাচ্ছে; পরিবহন ও টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তির কারণে দূরত্ব হ্রাস পাচ্ছে; সাংস্কৃতিক সমন্বয় ঘটছে এবং জাতীয় অর্থনীতি গুলো একটি নির্ভরশীল ও সমন্বিত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হচ্ছে। সাধারণত যে প্রক্রিয়া দ্বারা এটি ঘটে তাকে বিশ্বায়ন বলা হয়।
বিশ্বায়ন হলো বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের যুগের একটি বহুল প্রচলিত ও সর্বগ্রহণযোগ্য ধারণা। বিশ্বায়ন বলতে বিশ্বেও বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত বিভিন্ন অংশের মানুষের মধ্যে পরস্পর নির্ভরশীল সম্পর্কের সম্প্রসারণকে বোঝায়। সাধারণ কথায় বিশ্বায়ন বলতে সমগ্র বিশ্বের পুঁজি ও প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ, মুক্তবাজার অর্থনীতি, তথ্য প্রযুক্তির সম্প্রসারণ, ব্যবসায়িক,সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের অবাধ চলাচলের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী এক সেতুবন্ধন স্থাপনের প্রয়াসকে বোঝায়। অর্থাৎ বিশ্বায়ন হলো এমন এক ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ব একটি ‘একক বিশ্বব্যবস্থায়’ রূপান্তরিত হয়।
আন্তর্জাতিক ব্যবসা (International Business)
পৃথিবীতে কোনো দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, সে কারণে ব্যবসায়ের পরিধি একটি দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতি ও প্রসার লাভ করেছে। বিশ্বায়নের কারণে আমরা আরো বৈচিত্র্যময়, মানসম্পন্ন বা কম দামে পণ্য বা সেবা পেতে সক্ষম হয়েছি। দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে বিভিন্ন বিশেষায়িত পণ্য বা সেবার বিনিময় কার্যক্রমকে আন্তর্জাতিক ব্যবসা বলে।
অর্থাৎ দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে সংগঠিত বিক্রয়, বিনিয়োগ, পরিবহনসহ সব বাণিজ্যিক লেনদেন নিয়ে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক ব্যবসা। একটি দেশ যেসব পণ্য তুলনামূলকভাবে কম খরচে উৎপাদন করতে পারে সেসব পণ্যের উৎপাদনে বিশেষায়ন করতে পারে এবং পরবর্তীতে এসব পণ্যের উদ্বৃত্ত অংশ অপরাপর দেশে উদ্বৃত্ত পণ্যের সাথে বিনিময় করে। একটি দেশ যখন বিভিন্ন পণ্য বা সেবাকর্ম অন্যান্য দেশের নিকট বিক্রয় করে তখন তাকে রপ্তানি বলে। আর একটি দেশ অন্যান্য দেশের নিকট থেকে যখন পণ্য ও সেবাকর্ম ক্রয় করে তখন তাকে আমদানি বলে। পরিশেষে বলা যায়,সাধারণত প্রাকৃতিক সম্পদের বৈচিত্র্যতা, কারিগরি দক্ষতায় ভিন্নতা, পণ্যের বিশেষীকরণ, শ্রম দক্ষতার পার্থক্য, মুদ্রাব্যবস্থার পার্থক্য ইত্যাদি কারণে দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে যে ব্যবসায়িক সম্পর্ক তৈরি হয়, তাকে আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বা বাণিজ্য বলে। উদাহরণ স্বরূপ, বাংলাদেশ প্রধানত তৈরি পোশাক, কৃষিজাত পণ্য যেমন: পাট ও পাটজাত দ্রব্য,হিমায়িত চিংড়ি ইত্যাদি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। আবার বাংলাদেশে কয়লা, পেট্রোলিয়াম ও পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্য, শিল্পের কাঁচামাল, মূলধনী যন্ত্রপাতি ইত্যাদি বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করে।
আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ের গুরুত্ব (Significance of International Business)
দুটি দেশের মধ্যে উপকরণের সহজলভ্যতা, উৎপাদন ও দক্ষতার বিশেষীকরণ বা শ্রম বিভাগই হলো আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ের মূল ভিত্তি। বিশ্ব অর্থনীতি এখন কেবলমাত্র পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল নয়; আন্তঃসংযুক্তও বটে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য একটি দেশের সম্পদ বৃদ্ধিতে ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে নানাভাবে প্রভাবিত করতে পারে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ের যেমন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে, তেমনি সাধারণ ব্যবসায়ী ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য ও আন্তর্জাতিক ব্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
(ক) ভোক্তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে (From the View Point of Consumers)
(১) সুবিধাজনক মূল্যের মানসম্মত পণ্য ভোগ (Enjoy Quality Products at a Convenient Price)
মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়। ফলে দেশের আন্তর্জাতিক উৎপাদন ব্যয় যেমন হ্রাস পায়, তেমনি ভোক্তারা প্রতিযোগিতামূলকভাবে কম মূল্যে বিভিন্ন দেশের আমদানীকৃত পণ্য ব্যবহারের সুযোগ পায়। এছাড়া প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য উৎপাদনকারীরা পণ্যের মানোন্নয়ন ও ভোক্তার সন্তুষ্টি বৃদ্ধির জন্য সচেষ্ট থাকে।
(২) অনুৎপাদিত ও নতুন পণ্য ভোগ (Consumption of Unproduced and New Goods)
কোনো দেশ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তাই যে সকল পণ্যদ্রব্য সংশ্লিষ্ট দেশে উৎপাদন করা সম্ভব হয় না, আমদানির মাধ্যমে যে সকল পণ্যদ্রব্যের দেশীয় চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়। যেমন : বাংলাদেশ গাড়ি, কম্পিউটার, রেফ্রিজারেটর ইত্যাদি আমদানি করতে পারে। আবার পাট, চা, চামড়া, জামদানি কাপড় রপ্তানি করতে পারে। আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে ভোক্তারা সহজেই উন্নত দেশের নতুন নতুন উদ্ভাবিত পণ্য ব্যবহারেরও সুযোগ পায়।
(৩) কর্মসংস্থানের সুযোগ (Opportunity for Employment)
আন্তর্জাতিক ব্যবসায় দেশের উৎপাদনকে আরো ত্বরান্বিত করে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। সেই কারণে উৎপাদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ভোক্তার নিকট পণ্য দ্রব্য পৌঁছানো পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে অসংখ্য জনবলের প্রয়োজন হয়। ফলে একদিকে যেমন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি জনগণের জীবনযাত্রার মানও উন্নত হচ্ছে।
খ) উৎপাদনকারীর দৃষ্টিকোণ থেকে (From the View Point of Producers)
(১) দেশীয় বাজার সম্প্রসারণ (Expansion of Domestic Market)
আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ের কারণে বিদেশের বাজারে দেশীয় পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ফলে বিশ্বব্যাপী দেশীয় বাজার সম্প্রসারণের সুযোগ পায়, ফলে উৎপাদনকারীর উৎপাদনের পরিমাণ ও বৃদ্ধি পায়।
(২) উৎপাদন ব্যয় হ্রাস (Reduction of Production Cost)
আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ের মাধ্যমে উৎপাদনকারী সংশ্লিষ্ট দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা পূরণ করে অতিরিক্ত পণ্য
বিদেশের বাজারে বিক্রি করে। এতে উৎপাদনকারীর জন্য বৃহদায়তন উৎপাদনের সুযোগ তৈরি হয়। ফলে পণ্যের উৎপাদন
ব্যয় হ্রাস পায় এবং বাজার বৃদ্ধির সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
(৩) ব্যবসায়িক ঝুঁকি হ্রাস (Reduction of Business Risk)
আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ে বাজার পরিধি বৃদ্ধির কারণে উৎপাদনকারীর ব্যবসায়িক ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। কোনো একটি
বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হলে অন্য বাজার দ্বারা উক্ত ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব হয়।
(গ) অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে (From View Point of Economy)
(১) অর্থনৈতিক উন্নয়ন (Economic Development)
পৃথিবীর প্রত্যেক দেশ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য নিজেদের সম্পদ ও উপকরণ প্রাপ্তির সুবিধা, দক্ষতা অনুসারে
সর্বোচ্চ উৎপাদন করতে পারে। ফলে দেশে অব্যবহৃত সম্পদের সঠিক ব্যবহার, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, উৎপাদন বৃদ্ধি তথা
সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটে।
(২) সম্পদের উত্তম ব্যবহার (Proper Utilization of Resources)
আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ের মাধ্যমে যেমন একটি দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটে, তেমনি উন্নত যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তিবিদ্যা
আমদানির ফলে দেশের প্রাকৃতিক সম্পত্তিগুলোর উত্তম ব্যবহার ঘটে এবং উৎপাদিত পণ্যের বাজার বিস্তৃত হয়।
(৩) আবশ্যকীয় পণ্য আমদানি (Importing Essential Goods)
মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে আমদানির ভূমিকা অপরির্হায। কোনো দেশে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের স্বল্পতা বা
ঘাটতি দেখা দিলে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী আমদানি করে অভাব পূরণ করা যায়।
(৪) রপ্তানি আয় বৃদ্ধি (Export Receipt Growth)
কোনো দেশ তার প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পণ্য উৎপাদন করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে উদ্ধৃত্ত পণ্য বিদেশে রপ্তানি
করতে পারে। ফলে রপ্তানি বৃদ্ধি পায়। যেকোনো অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে এই রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ব্যাপক
প্রভাব বিস্তার করে। বাংলাদেশের মতো মধ্যম আয়ের দেশের ক্ষেত্রে অর্থনীতিতে রপ্তানির ভূমিকা নিচে দেওয়া হলো :
(৫) কারিগরি ও প্রযুক্তি জ্ঞানের প্রসার (Expansion of Technical and Technological Knowledge)
যে সমস্ত অনুন্নত বা স্বল্পোন্নত দেশ কারিগরি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে, সেসব দেশ আন্তর্জাতিক
বাণিজ্যের মাধ্যমে শিল্পোন্নয়নের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় জ্ঞান, প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করতে পারে। এ ছাড়া দেশের
উৎপাদনের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
(৬) মূলধনের গতিশীলতা বৃদ্ধি (Increasing the Mobility of Capital)
একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে মূলধনের গতিশীলতা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে। বিভিন্ন দেশের সাথে আন্তর্জাতিক
ব্যবসায়ের সুবিধার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের মূলধনের আমদানি ও রপ্তানির গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়।
(৭) মানবসম্পদ রপ্তানি (Export of Human Resources)
আন্তর্জাতিক ব্যবসায় একটি দেশের মানবসম্পদ তৈরি ও রপ্তানিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ে যুক্ত
দেশগুলো মানবসম্পদ রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে। এতে যেমন দেশের বেকারত্ব দূর হয়,
তেমনি দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি হয়।
পরিশেষে বলা যায়, বিশ্বায়নের এই যুগে সকল দেশই অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ের ওপর নির্ভরশীল।
একটি দেশের সাধারণ ভোক্তা, উৎপাদক থেকে শুরু করে সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ওতপ্রোতভাবে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ের
ওপর নির্ভরশীল। তাই বলা যায়, সামগ্রিক বিশ্বের উন্নয়নে আন্তর্জাতিক ব্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে।
লেখকঃ আমু, ব্যাংকার।
Leave a Reply