আমদানি পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনায় যাবার পূর্বে আমদানি সম্পর্কে আমরা একটু জেনে নেই। মানুষের চাহিদা এবং
প্রয়োজন অপরিসীম এবং বৈচিত্র্যময়। মানুষের অপরিসীম ও বৈচিত্র্যয় চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণের সকল পণ্য বা সেবা
উৎপাদন ও বন্টন কোন দেশের পক্ষেই একক ভাবে সম্ভব নয়। তাই প্রয়োজন দেখা দেয় বিদেশ থেকে পণ্য বা সেবা
আমদানির। সহজ কথায় প্রয়োজনীয় পণ্য বা সেবা বিদেশ থেকে সংগ্রহ বা μক্রয়কেই বলা হয় আমদানি। সাধারণতঃ কোন দেশ
প্রয়োজনীয় পণ্য-দ্রব্য বা সেবা উৎপাদন করতে না পারলে বা উৎপাদন ব্যয় তুলনামূলক বেশি হলেই তা বিদেশ থেকে
আমদানি করে থাকে।
আমদানি সম্পর্কে P. H. Collinবলেন যে, বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে বিদেশ থেকে দেশের মধ্যে পণ্য সামগ্রী ক্রয় করে আনা
(Import means brought goods into a country from abroad for sale)
Y. P. Singh এবং M. Saeed বলেন যে, বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করে অন্য দেশসমূহ থেকে পণ্য বা সেবাসমূহ ক্রয় করে
আনাই হলো আমদানি (Import means purchase of goods or services from other countries involving the use of foreign exchange)
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি যে, কোন দেশ বা সে দেশের ব্যবসায়ী সমাজ যখন বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে বিদেশ
থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় কোন পণ্য দ্রব্য বা সেবাদি ক্রয় করে আনে, তখন তাকে আমদানি বলে। অন্য ভাবে বলা যায়, স্থানীয় বাজারের চাহীদা পূরণ বা উৎপাদন ঘাটতি জনিত কারনে জনগণের খাদ্য সংকট দূরীকরণ বা সরকারের প্রয়োজনে অন্য কোন দেশ থেকে বৈদেশিক মূদ্রার বিনিময়ে খাদ্যদ্রব্য/পণ্যসামগ্রী/সেবাগ্রহণ করলে তাকে আমদানি বলে।
যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এরূপ কাজ করে তাকে বলা হয় আমদানিকারক।
আমদানি প্রণালী বা পদ্ধতি (Import Procedure)
বিদেশ থেকে পণ্য বা সেবা আমদানি করতে হলে বিশেষ কিছু আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়। এই আনুষ্ঠানিকতাকে বলা
হয় আমদানি পদ্ধতি। আমদানি পদ্ধতিকে কিছু ধারাবাহিক পদক্ষেপ রয়েছে, যা নিম্নরূপ-
১) আমদানি অনুমতিপত্র সংগ্রহ
২) তথ্যাদি অনুসন্ধান
৩) ফরমায়েশ প্রদান
৪) বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ
৫) প্রত্যয়পত্র/ঋণপত্র খোল
৬) বিনিময় হার নির্ধারণ
৭) পণ্য প্রেরণের সংবাদ প্রাপ্তি
৮) বিল প্রাপ্তি, বিল পরিশোধ ও দলিল পত্রাদি সংগ্রহ
৯) শুল্ক বিষয়ক আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন
১০) পণ্য খালাস
১১) লেনদেনর পরিসমাপ্তি
১) আমদানি লাইসেন্স সংগ্রহঃ
যে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে দেশে পণ্য-দ্রব্য এবং সেবা আমদানি করতে আগ্রহী হলে প্রথমেই তাকে আমদানি
লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হয়। আমদানি লাইসেন্স প্রদান করে সরকারের আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রক। এজন্য আমদানিকারীকে
নির্ধারিত ফরমে এবং নির্ধারিত ফি সহ সকল তথ্য দিয়ে আবেদন করতে হয। সাধারণতঃ দেশের স্বার্থের প্রতিকূল না হলে
এবং আমদানি নীতির সাথে সাদৃশ্য পূর্ণ হলেই আমদানির লাইসেন্স ইস্যু করা হয়। আমদানি লাইসেন্স পেলেই
আমদানিকারী বিদেশ থেকে তার প্রয়োজনীয় পন্য-দ্রব্য বা সেবা আমদানি করতে পারে।
২. তথ্যাদি অনুসন্ধানঃ
আমদানির লাইসেন্স সংগ্রহের পর আমদানিকারক তার প্রয়োজনীয় পণ্য-দ্রব্য বা সেবাদি ক্রয়ের আগ্রহ প্রকাশ করে বিভিন্ন
দেশের বিভিন্ন উৎপাদক বা সরবরাহকারী অথবা তাদের এদেশীয় এজেন্টদের সাথে যোগাযোগ করে। এর মাধ্যমে সে
পণ্যের মান, গুণাগুণ, মূল্য এবং অন্যান্য শর্তাবলি সম্পর্কিত সকল তথ্যাদি সংগ্রহ করে।
৩. ফরমায়েশ প্রদানঃ
তথ্য অনুসন্ধানের মাধ্যমে আমদানিকারক সন্তোষ্ট হলে পণ্য-দ্রব্য বা সেবার জন্য ফরমায়েশ প্রদান করে। এই ফরমায়েশ
পত্রে পণ্যের সকল তথ্য অর্থাৎ পণ্যের নাম, মান, মূল্য, পরিমাণ, প্রকৃতি মূল্য পরিশোধ পদ্ধতি, পণ্য প্রেরণের তারিখ এবং
অন্যান্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ উল্লেখ করে। এরূপ ফরমায়েশকে বলা হয় বন্ধ বা স্থীর ফরমায়েশ। অপরদিকে ফরমায়েশে
সকল তথ্য সম্পূর্ণ উল্লেখ না করে কিছু রপ্তানিকারকের উপর ছেড়ে দেয়া হলে, তাকে বলা হয় মুক্ত বা খোলা ফরমায়েশ।
৪. বৈদেশিক মুদ্রা যোগান সংগ্রহঃ
এই পর্যায়ে আমদানিকারক পণ্যের পরিমাণ ও মূল্যের আলোকে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে। এজন্য
আমদানিকারককে তার ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিকট থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের জন্য নির্দিষ্ট ফরমে
দরখাস্ত করে।
৫. প্রত্যয়পত্র/ঋণপত্র খোলাঃ
রপ্তানিকারকের নিকট থেকে ফরমায়েশ পত্র গ্রহণের খবর এবং প্রত্যয়পত্র খোলার অনুমতি পাবার পর আমদানিকারক তার
ব্যাংকের মাধ্যমে রপ্তানিকারকের অনুকূলে প্রত্যয়পত্র খোলে। এই প্রত্যয়পত্রের মাধ্যমে ব্যাংকক রপ্তানিকারীকে নিশ্চয়তা প্রদান
করে যে, আমদানিকারী ব্যর্থ হলে সে তা পরিশোধ করবে। প্রত্যয়পত্রের একটি কপি ব্যাংকের মাধ্যমে রপ্তানিকারীর নিকট
পাঠিয়ে দেয়া হয়।
৬. বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণঃ
বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার উঠানামা করলে যেন আমদানি প্রক্রিয়ায় সমস্য সৃষ্টি না হয়, এজন্য আমদানিকারক তার
ব্যাংকের সাথে মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করে চুক্তি সম্পাদন করে। মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ সংক্রান্ত চুক্তির কপিও
রপ্তানিকারকের পাঠিয়ে দেয়া হয়।
৭. পণ্য-দ্রব্য প্রেরণ সংবাদ প্রাপ্তিঃ
ইতোমধ্যে রপ্তানিকারকের নিকট হতে আমদানিকারক তার প্রয়োজনীয় পণ্য-দ্রব্য জাহাজে প্রেরণের সংবাদ সংক্রান্ত পত্র
পেয়ে থাকে। এই পত্রের মাধ্যমে পণ্যে নাম, পরিমাণ, জাহাজের নাম এবং পণ্য বোঝাই, জাহাজ বন্দরে পৌঁছার সম্ভাব
তারিখ ইত্যাদি তথ্য আমদানিকারক পেয়ে থাকে।
৮. বিল ও দলিলপত্র প্রাপ্তি এবং মূল্য পরিশোধ
পণ্য-দ্রব্য প্রেরণের সংবাদ প্রাপ্তির কয়েক দিনের মধ্যে আমদানিকারক রপ্তানিকারীর নিকট থেকে বিনিময় বিলসহ অন্যান্য গুরুত্বপর্ণ দলিলপত্র যা চালানি রশিদ, বহনপত্র, বীমাপত্র, বাণিজ্যিক দূতের প্রত্যয়পত্র ইত্যাদি পেয়ে থাকে। তবে দলিলপত্র ব্যাংকের মাধ্যমে প্রেরিত হয় এবং আমদানি কারক বিলের অর্থ নগদে পরিশোধ করে অথবা বিলে স্বীকৃতি দিয়ে তা ব্যাংক
থেকে গ্রহণ করে।
৯. শুল্ক সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিকতা পালনঃ
পণ্য বোঝাই জাহাজ বন্দরে ভিড়লে বা ভিড়ার সময় চলে আসলে আমদানিকারক বা তার প্রতিনিধি প্রয়োজণীয় দলিলপত্রসহ দুই কপি আগামপত্র (Bill of Entry) তৈরি করে শুল্ক কর্তৃপক্ষের নিকট আমদানির ঘোষণা দেয়। শুল্ক কর্তৃপক্ষ সকল কাগজপত্র পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হলে প্রয়োজনীয় শুল্ক নির্ধারণ ও আদায় করে (যদি পণ্য-দ্রব্য শুল্কযোগ্য হয়) স্বাক্ষর ও সীলসহ আগাম পত্রের একটি কপি আমদানিকারক বা তার প্রতিনিধিকে ফেরৎ দেয়। শুল্ক কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষর ও সীলযুক্ত এইআগামপত্রটিই “কাষ্টম পাস” (Custom Pass) হিসেবে গৃহীত হয়।
১০. পণ্য-দ্রব্য খালাসঃ
নির্ধারিত বন্দরে জাহাজ ভিড়লে আমদানিকারক বা প্রতিনিধিকে জেটি চালান ফরম পূরণ করে এবং জেটি চার্জ ও অন্যান্য চার্জ প্রদান করে বন্দর কমিশনারের নিকট দাখিল করতে হয়। অপর দিকে পণ্য-দ্রব্য খালাসের জন্য জাহাজের ফোরম্যানের নিকট সকল দলিলপত্র জমা দিয়ে পণ্য-দ্রব্য খালাসের আদেশ এবং গেট পাস সংগ্রহ করতে হয়। পণ্য খালাসের আদেশ ও গেট পাস পাবার পর আমদানিকারক বা প্রতিনিধি পণ্য-দ্রব্য খালাস করতে পারে। তবে জাহাজের ভাড়া রপ্তানিকারক দিয়ে না থাকলে পণ্য খালাস আদশে এবং গেট পাস পাবার পূর্বে আমদানিকারকে তা পরিশোধ করতে হয়।
১১. লেনদেনের পরিসমাপ্তিঃ
আমদানিকৃত পণ্যদ্রব্য জাহাজ থেকে গ্রহণের পর ইহার যথার্থতা সম্পর্কে সন্তুষ্ট হয়ে রপ্তানিকারকের নিকট সংবাদ প্রদান করলেই উভয়ের মধ্যে লেনদেনের পরিসমাপ্তি ঘটে। উল্লেখ্য যে, পণ্যের মান বা গুণাগুণ বা পরিমাণ সম্পকে কোন সমস্যা দেখা দিলে তা পাস্পারিক যোগাযোগ বা বাণিজ্যিক দূত বা বণিক সমিতির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যেতে পারে।
Leave a Reply