সামাজিক অসঙ্গতি দূর করে মানবিক সমাজ গঠনের প্রত্যয়ে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লেখা আনিচ মুন্সীর প্রথম প্রবন্ধ গ্রন্থ “ আমু ভাইয়ের প্রাসঙ্গিক বিষয়”। বইটি পড়ে পাঠ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন মুহাম্মদ শাহাদৎ হোছাইন।
আনিচ মুন্সির এ প্রবন্ধ সংকলনটি মুলত একজন সমাজ সংস্কারকের মনের কথা, মনের আক্ষেপ। সমাজ নিয়ে তিনি ভাবেন। সমষ্টিগত স্বার্থ নিয়ে তিনি চিন্তা করেন, ব্যক্তি স্বার্থের তুলনায় তিনি সামাজিক স্বার্থকে প্রধান্য দেন। এককভাবে ভালো থাকার চাইতে পারস্পরিক সহযোগিতায় সবার মঙ্গল সাধনই আনিচ মুন্সির মনের বাসনা। তিনি তার প্রতিটি প্রবন্ধেই সমাজ বাস্তবতা তুলে ধরেছেন এবং করণীয় সম্পর্কে তার মতামত উপস্থাপন করেছেন।
“শিক্ষক হচ্ছেন জাতি গঠনের মহান কারিগর” প্রবন্ধে একটি জাতিস্বত্বা হিসেবে আমাদের বেহাল দশা তিনি চিহ্নিত করেছেন। পর্যাপ্ত শিক্ষা সামগ্রীর মধ্যে বসবাস করেও আমরা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারছি না। শিক্ষকগণ খুব অল্প দামে নিজেদের বিকিয়ে দেন নিজেদের আবশ্যক কর্মসম্পাদন না করে। শর্ট সাজেশন শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকদের পাঠদানে অনাগ্রহ, কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে অশিক্ষার প্রতি ছাত্রদের ধাবিত করে। এ বিচ্যুতি তাকে খুব আহত করে। সুশিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা ও মানবিক শিক্ষার খুব অভাব দেখছেন তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নামক এ সকল সার্টিফিকেট তৈরির কারখানাগুলোতে। এর মাঝেও মেধার বিকাশ যে ঘটছেনা তা নয়। তবে যা হচ্ছে তা নিজেদের প্রচেষ্টায়। অর্থাৎ তিনি মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ক্রেডিট দিতে নারাজ। কোন বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জন না করে আংশিক জ্ঞান অর্জন করে বিশেষজ্ঞ সুলভ আচরনের তিনি বিরোধিতা করেন।
“বুদ্ধিমান লোকেরা ঘুষ খায় না” প্রবন্ধে ঘুষ ও স্পীড মানির পার্থক্য নির্ণয় করে ঘুষের একটি চমৎকার সংজ্ঞা তিনি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন “ঘুষ হচ্ছে সাধারণ জনগণকে হয়রানি না করার প্রতিশ্রুত পারিশ্রমিক যা বিভিন্ন কৌশলে বা বিভিন্ন লোকের সহযোগিতায় সাধারণ জনগণের নিকট থেকে আদায়কৃত অর্থ”। সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে তাত্তি¡ক জ্ঞান লাভ না করেও তিনি সমাজ বিজ্ঞানের একটি মৌলিক বিষয়ে সীমিত কয়েকটি শব্দ দিয়ে যে সংজ্ঞা তৈরি করেছেন তা আনিচ মুন্সির সমাজ বিষয়ে চমৎকার মুন্সিয়ানার বহিঃপ্রকাশ বটে। ঘুষ যে কিভাবে ঘুষগ্রহীতার জীবনে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে সে বিষয়ে লোকজনের যথার্থ সংবেদনশীলতা থাকলে মানুষ কখনো ঘুষ গ্রহন করত না। তাই সবারই ভালো থাকার স্বার্থে কারোরই ঘুষ গ্রহণ করা উচিৎ নয়।
“মানসিকতার পরিবর্তন করুন, জীবনের পরিবর্তন ঘটবেই” এ অংশে তিনি জাতি হিসেবে আমাদের নেতিবাচক মানসিকতা নিয়ে চমৎকার সব উপমা দিয়ে তা আমাদের কাছে বোধগম্য করে তুলেছেন। তাছাড়া আমাদের আত্মবিশ্বাসহীনতাও তাকে দারুনভাবে পীড়িত করে। তার ভাষায় ‘ আমরা কেউ অযোগ্যতার কারণে হেরে যাই না বরং আমাদেরও যে যোগ্যতা আছে আমরা অনেকে তা বিশ্বাসই করতে পারিনা।’
“একতাই বল ” অংশে আনিচ মুন্সি মানুষের যৌথতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। মানুষের শক্তি মূলত যৌথতায়। বিচ্ছিন্নতায় মানুষ অসহায় হয়ে যায় তথাপি মানুষ বিশেষ করে তথাকথিত শিক্ষিত স্ত্রীদের ভূমিকার কারণে বর্তমানে যৌথ পরিবার প্রথা ভেঙ্গে অনু পরিবারে আশ্রয় নিচ্ছে যা সামগ্রিকভাবে মানুষের অসহায়ত্বকে আরো প্রগাঢ় করেছে।
“বিসিএস পাশ বেকার ”প্রবন্ধে তিনি আমাদের জাতীয় বাস্তবতায় একজন মেধাবী সিভিল সার্ভিস তথা সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও বেকার থাকার মতো বাস্তবতা যে আমাদের জাতির জন্য যে কতটুকু হতাশাব্যঞ্জক তা তিনি চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। তাছাড়া সরকারী চাকুরিতে নিয়োগের ধরনের ভিন্নতার কারণে যে একধরণের পার্থক্য বা বৈষম্য আমরা তৈরি করি তা অযাচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন। তার মতে মর্যাদা নির্ধারিত হওয়া উচৎ কজের ধরণ অনুসারে, অন্য কিছু দিয়ে নয়।
“সুখ তুমি কি?” অংশে মানুষের সুখ যে একটি চরম আপেক্ষিক বিষয় তা তিনি নিজে বুঝেছেন এবং আমাদেরও বুঝিয়েছেন। তার ভাষায় ‘ যে যাই বলুক ভাই আমার সোনার হরিণ চাই এই নীতি গ্রহণ করে কেউ যদি জীবন বাস্তবতাকে অস্বীকার করে শুধু সুখের পিছনে ছুটতে থাকে তবে সে কখনো সুখের সন্ধান পবে না বরং কাঙ্খিত জিনিস না পাওয়ার দুঃখবোধ বাড়বে। তার ভাষ্যে সুখ-দুঃখ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই সুখকে নিয়ে এত লালায়িত হওয়ার প্রয়োজন নেই।তথাপি তার চাওয়া ‘দুনিয়ার সকল প্রানী সুখী হোক।’
“দিলি¬কা লাড্ডু খাইলেও পস্তাবে না খাইলেও প্রস্তাবে” অংশে তিনি খুবই সাবলীল ভাষায় বিয়ে করতে গিয়ে সঙ্গী নির্বাচেনের জটিলতা তুলে ধরেছেন। কত কাঠ-খড় পুড়িয়ে মানুষকে বিয়ে করতে হয় তা তিনি বুঝিয়েছেন। সঙ্গী নির্বচনের ক্ষেত্রে এলাকা, সংস্কৃতি, মানসিক নৈকট্য ইত্যাদি বিষয় নিশ্চিত করার ইঙ্গিত করলেও বিয়ে করে সুখী হওয়ার নিশ্চয়তা খুব কম থাকে। তবে এলাকাগত বৈশিষ্ট্য নিরুপণ করতে গিয়ে তিনি চারটি জেলার লোকজন নিয়ে যা বলেছেন তা আমার কাছে বর্ণবাদী মনে হয়েছে। পরিশেষে তার পরামর্শ আমার ভালো লেগেছেঃ ‘বিয়ে না করা ভালো, তবে যদি করতে চাও দ্রুত করে ফেল’।
“মানুষ হওয়া কঠিন ব্যাপার” অংশে আমাদের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠার ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার কথা তুলে ধরেছেন। একটি শিশু তার শৈশব থেকে প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য যেসকল অনকূল পরিবেশ এবং তার চারপাশের মানুষ অর্থাৎ বাবা-মা এবং শিক্ষকগণের কাছ থেকে যেরকম অনুপ্রেরণা পাওয়া উচিৎ তা সে পায় না। ফলে আমাদের প্রকৃত মানুষ হওয়া দুরুহ হয়ে দাঁড়ায়। শারিরীকভাবে মানুষ হয়েও প্রকৃত মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের অসংগতি আনিচ মুন্সিকে দারুণভাবে আহত করেছে।
“বৃত্তে বন্দী মধ্যবিত্ত”মনুষ্যত্বহীন প্রাণী যাদের আচরণ অনেক সময় পশুকে হার মানায়। হিংস্রতাকে উৎসাহিত করতে মানুষ বাঘ-সিংহের উদাহরণ নিয়ে আসে। মধ্যবিত্তের সংগ্রামকে তিনি চমৎকারভাবে উপলব্ধি করেছেন এবং উপস্থাপন করেছন।
“অর্থই সকল অনর্থের মূল” অতিরিক্ত অর্থ অনর্থ সৃষ্টি করে তাই অবৈধ অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনে যেমন ব্যক্তিগত সদিচ্ছার পাশাপাশি সরকারের করণীয় সম্পর্কে যদি একটু বলতেন। বিশেষ করে যে দেশে নির্দিষ্ট সেক্টরে কালো টাকা বিনিয়োগ করলে কোনো ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হবে না মর্মে সরকার গ্যারান্টি প্রদান করে।
“ডাবল স্ট্যান্ডার্ড” এ চমৎকারভাবে বাঙালীর সুবিধাজনকভাবে অবস্থান পরিবর্তনের উদাহরণ দিয়েছেন।
“পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায়” ঃ ব্যক্তিগত গাড়ীর ব্যবহার কমানো, এসির ব্যবহার কমানো, গাছ লাগানোসহ পরিবেশ বান্ধব উদ্যোগে ব্যক্তিগত ও সরকারী ব্যবস্থা থাকা দরকার।
রাজনীতি মানে নীতির রাজা বা রাজার নীতি ঃ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন রোধে এই দুষ্ট চক্র থেকে বেরিয়ে আসার জন্য শুধু রাজনৈতিকভাবে সচেতনতাই যথেষ্ট কিনা?
জন্ম সূত্রে না কর্মসূত্রে মানুষঃ মানুষ হওয়ার শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য তিনি সকলের প্রতি উদাত্ত আহবান জানান। তার মতে মানুষ হিসেবে জন্ম যথেষ্ট না মানুষকে মানুষ হয়ে উঠতে হয়।
চমৎকার সব সমাজভাবনা আনিচ মুন্সির এই ‘আমু ভাইয়ের প্রাসঙ্গিক বিষয় ’ এ উঠে এসেছে। একটি যথাযথ মূল্যবোধ সম্পন্ন সমাজ গঠনে সুপাঠ্য এই বইখানি তরুণ সমাজের গোচরে আসা উচিৎ বলে আমি মনে করি। বইটি পাওয়া যাচ্ছে https://www.rokomari.com/book/219610/amu-vaier-prasongik-bisoy এই সাইটে
মুহাম্মদ শাহাদৎ হোসাইন,
প্রিন্সিপাল অফিসার,
সোনালী ব্যাংক লিমিটেড,
রুরাল ক্রেডিট ডিভিশন,
প্রধান কার্যালয়, ঢাকা।
Leave a Reply