রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে কর্মরত কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধা প্রদাণের ক্ষেত্রে দ্বৈত নীতির নিষ্ঠুর করাঘাতের শিকার নবীন কর্মকর্তারা। ২০০৭ সালে ব্যাংকগুলো পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিনত হবার পরে প্রবীণ এবং নবীন কর্মকর্তাদের মাঝে বেড়েছে বৈষম্য। ২০০৭ সালের পূর্বে এবং পরে যারা ব্যাংকে যোগদান করেছেন তাদের সুযোগ সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে বিভিন্ন আর্থিক ব্যবধান। এই বৈষম্যের মাত্রা এতো বেশি যে নবীন কর্মকর্তারা দিন দিন হতাশ হয়ে পড়ছেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেও ভুগছেন অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায়!
এসব বৈষম্যসমূহের মধ্যে মূল বৈষম্যটি হলো- জিপিএফ এবং সিপিএফ বৈষম্য। জিপিএফ হলো- জেনারেল প্রোভিডেন্ট ফান্ড ( পেনশন সুবিধার আওতাধীন কর্মকর্তা) এবং সিপিএফ হলো-কন্ট্রিবিউটরি প্রোভিডেন্ট ফান্ড ( গ্রাচুইটির আওতাধীন কর্মকর্তা) । এই দুই নিয়মের মাঝে আর্থিক ব্যবধান মোটামুটিভাবে নিচে উল্লেখ করা হলো-
১। একজন জিপিএফ/ পেনশন ভোগী মূল বেতনের ১০-৩০ শতাংশ ভবিষ্য তহবিলে জমা করতে পারেন, এখানে ব্যাংক কোন অনুদান প্রদান করে না। কিন্তু কর্তৃপক্ষ চাকুরী শেষে তাকে সমুদয় অর্থ মুনাফাসহ প্রদান করে থাকে। অন্যদিকে একজন সিপিএফ/ গ্রাচুইটি ভোগী কর্মকর্তা ভবিষ্যত তহবিলে তার মূল বেতনের ১০% জমা রাখতে পারেন; এক্ষেত্রে ব্যাংকও ৮-১০% অর্থ অনুদান হিসেবে প্রদান করে (এবং এক্ষেত্রে ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত ইন্টারেস্ট মাঝে মাঝেই কমানো হয়!)।
২। ২৫ বছর নিয়মিত চাকুরী শেষে একজন জিপিএফ/ পেনশন ভোগী কর্মকর্তা আনুতোষিক বাবদ ৮০ মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ প্রাপ্ত হন। অন্যদিকে একজন সিপিএফ/ গ্রাচুইটি ভোগী কর্মকর্তা সার্ভিস লাইফের দিগুন (২৫ বছর চাকুরী হলে ৫০, ৩০ বছর চাকুরী হলে ৬০) মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ আনুতোষিক বাবদ প্রাপ্ত হবেন। যা একজন জিপিএফ/ পেনশন ভোগী কর্মকর্তা তুলনায় অনেক কম। অর্থাৎ একজন সিপিএফ/ গ্রাচুইটি ভোগী কর্মকর্তা ২০-৩০ মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ কম প্রাপ্ত হবেন।
৩। একজন জিপিএফ/ পেনশন ভোগী তার প্রাপ্ত মাসিক পেনশন যা এককালীন জমা করলে ৪০ মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ প্রাপ্ত হন। অন্যদিকে একজন সিপিএফ/ গ্রাচুইটি ভোগীর ক্ষেত্রে পেনশনের কোন সুবিধাই রাখা হয়নি। ফলে একজন সিপিএফ ভোগী ৪০ মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ কম প্রাপ্ত হবেন।
৪। একজন জিপিএফ/ পেনশন ভোগীর ক্ষেত্রে সুপার এনুয়্যেশন তহবিলে ৩০% সঞ্চিতি রাখা হয়। অন্যদিকে একজন সিপিএফ/ গ্রাচুইটি ভোগীর ক্ষেত্রে গ্রাচুইটি তহবিলে ১৫% সঞ্চিতি রাখা হয়। এক্ষেত্রে ১০% অনুদান সহ হিসেব করলে মোট ৫% সঞ্চিতি কম রাখা হয়।
সার্বিক বিবেচনায় দেখা যায় যে, একজন সিপিএফ/ গ্রাচুইটি ভোগী একজন জিপিএফ/ পেনশন ভোগীর তুলনায় ২৫-৩০ বছর চাকুরী শেষে দেড়গুণ কম আর্থিক সুবিধা প্রাপ্ত হন যা প্রত্যক্ষ বৈষম্য।
এই বৈষম্য কমানোর প্রতিশ্রুতি ছিলো- ব্যাংকাদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল চূড়ান্তকরণের মাধ্যমে। তা আর হচ্ছে না এটি প্রায় নিশ্চিত। ফলে ২০০৭ সালের পরে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আর্থিক সুবিধাদীর ধরন বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মত হলেও তাদেরকে বেতন পেতে হয় সরকারি স্কেলে যা বৈষম্য না কমিয়ে তাদের ভবিষ্যতকে তিলে তিলে অন্ধকারের মাঝে ঠেলে দিচ্ছে। আর এর ফলে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের তরুণ কর্মকর্তারা ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়ছেন। সম্প্রতি কয়েকজন নবীন কর্মকর্তার মৃত্যুর ঘটনা এই হতাশাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কারন এসব কর্মকর্তাগন হঠাৎ মৃত্যু বরণ করায় তারা কোন সুযোগ সুবিধা পান না অথচ প্রত্যেকে বড় অংকের ঋণগ্রহীতা।
সুতরাং এই বৈষম্য যতো দ্রুত সম্ভব কমানো উচিৎ। তাছাড়া একই প্রতিষ্ঠানে দুই নীতি অশোভনীয়ও বটে! সরকার যেখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের জন্যও পেনশন সুবিধা চালু করতে ইচ্ছুক সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর নবীন কর্মকর্তারা কেন পেনশন সুবিধার বাইরে থাকবে? বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকসমূহের ব্যবস্থাপনা পর্ষদ, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ , অর্থমন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষ এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যৌক্তিক এবং মানবিক দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
—————————————————–
লেখা: সাকিব জামাল, প্রিন্সিপাল অফিসার, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড।
Leave a Reply