সহজ কথায় রপ্তানি পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনায় যাবার পূর্বে রপ্তানি বলতে মূলত কি বুঝায় তা আমরা জানার চেষ্টা করবো। নিজের দেশ থেকে অন্য দেশে পণ্য-দ্রব্য বা সেবাকর্মের বিক্রয় বা প্রেরণকে রপ্তানি বা রপ্তানি বাণিজ্য বলে।আমরা জানি মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজন অপরিসীম এবং বৈচিত্র্যময়। দেশের মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎস ব্যর্থ হলেই আমদানির প্রশ্ন আসে এবং এই আমদানির মধ্যে দিয়েই রপ্তানি কার্যটি সম্পাদিত হয়। যেমন- ভারতে ইলিশ মাছের উৎপাদন নেই। কিন্তু চাহিদা প্রচুর। ভারত তা বাংলাদেশ থেকে আমদানি করলো। ভারতের এই আমদানির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রপ্তানি সম্পন্ন হলো। কোন একটি দেশ তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য-দ্রব্য বা সেবা কর্মাদি যখন অন্য দেশের প্রেরণ করে, তাকে রপ্তানি বলা হয়।
রপ্তানির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে P. H. Collin বলেন যে, বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে বিদেশে পণ্য প্রেরণই হলো রপ্তানি (Export means
goods sent to a foreign country to be sold)
Y. P. Singh এবং M. Saeed বলেন যে, বিদেশে কোন পণ্য বা সেবাকর্মের বিক্রয়কে রপ্তানি বলে (Export means any
goods or services sold to a foreign country)
উপরের আলোচনার আলোকে আমরা বলতে পারি যে, কোন দেশের প্রয়োজন অতিরিক্ত পণ্য-দ্রব্য বা সেবাকর্মাদি যখন
অন্য কোন দেশে বিক্রয় করা হয়, তাকে আমরা বলবো রপ্তানি। অন্যভাবে বলা যায়, দেশের উদ্বৃত্ত পণ্য ও সেবা সামগ্রী অন্য দেশে বিক্রয় করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাকে রপ্তানি বলে। যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রপ্তানি কার্যসম্পাদন করে তাকে বলা হয় রপ্তানিকারক। রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায়। তাই যে দেশের রপ্তানি যতো বেশি সেই দেশেরঅর্থনৈতিক অবস্থা ততো উন্নত।
রপ্তানি প্রণালী বা পদ্ধতিঃ (Export Procedure)
পণ্য-দ্রব্য বা সেবা রপ্তানি করতে গেলে বেশ কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। এ সকল নিয়ম-কানুনকেই রপ্তানি পদ্ধতি
বলে। রপ্তানি পদ্ধতির পদক্ষেপগুলোকে নিম্নরূপে বর্ণনা করা যায়ঃ
১) ফরমায়েশ প্রাপ্তি
২) ফরমায়েশ গ্রহণ
৩) প্রত্যয়পত্র/ঋণপত্র খোলার নির্দেশ
৪) বিনিময় হার নির্ধারণ
৫) সরকারের অনুমতিপত্র সংগ্রহ
৬) পণ্য সংগ্রহ
৭) জাহাজ ভাড়ার চুক্তি সম্পাদন
৮) পণ্যের বীমাকরণ
৯) শুল্ক সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিকতা
১০) জাহাজে মাল/পণ্য বোঝাই
১১) পণ্য প্রেরণের সংবাদ প্রেরণ
১২) দলিল পত্র তৈরি ও প্রেরণ
১৩) মূল্য প্রাপ্তি
১৪) লেনদেনের পরিসমাপ্তি
১. ফরমায়েশ প্রাপ্তিঃ
পণ্য-দ্রব্য রপ্তানি প্রক্রিয়ায় প্রথমেই রপ্তানিকারক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আমদানিকারকের নিকট থেকে পণ্য-দ্রব্য ক্রয়ের ফরমায়েশ পত্র পেয়ে থাকে। ফরমায়েশ দুই প্রকার হয়ে থাকে। যথা-
ক. বন্ধ বা স্থির ফরমায়েশঃ যে ফরমায়েশে পণ্যের সকল তথ্য অর্থাৎ পণ্যের নাম, গুণাগুণ, মূল্য, পরিমাণ, প্যাকিং
পদ্ধতি, উৎপাদকের নাম, মুল্য পরিশোধ পদ্ধতি, পণ্য প্রেরণের তারিখ, বীমা পদ্ধতি ইত্যাদি উল্লেখ থাকে, তাকে বন্ধ বা স্থির ফরমায়েশ বলে। এই ফরামায়েশে নিজস্ব চিন্তা ও সময় ব্যয় কম হয়।
খ. মুক্ত বা খোলা ফরমায়েশঃ যে ফরমায়েশে শুধুমাত্র পণ্যের নাম ও পরিমাণ উল্লেখ থাকে, তাকে খোলা বা মুক্ত ফরমায়েশ বলে। এই ফরমায়েশে রপ্তানিকারকের উপরই বাকি বিষয়াদি স্থির করার দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া হয়। ফলে তার চিন্তা ও সময় বেশি ব্যয় হয়।
২. ফরমায়েশ গ্রহণ
ফরমায়েশ প্রাপ্তির পর রপ্তানিকারক তার বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা ও পরীক্ষা করে দেখেন। পরীক্ষা ও পর্যালোচনায় যদি সব কিছু তার অনুকূলে হয় তবে সে তা গ্রহণ করে এবং ইহার সংবাদ আমদানিকারীকে প্রদান করে।
৩. প্রত্যয়পত্র/ঋণপত্র খোলাঃ
আমদানিকারকের নিকট থেকে ফরমায়েশের স্বীকৃতি গ্রহণের পর রপ্তানিকারক আমদানিকারকে প্রত্যয়পত্র খোলার অনুরোধকরে। প্রত্যয়পত্রের মাধ্যমে আমদানিকারকের দেশের ব্যাংক আমদানিকৃত পণ্য-দ্রব্যের মূল্য পরিশোধ সম্পর্কে রপ্তানিকারককে অংগীকার ও নিশ্চয়তা প্রদান করে।
৪. রপ্তানি লাইসেন্স সংগ্রহঃ
বিদেশে পণ্য প্রেরণ করতে হলে রপ্তানিকারককে আমদানি রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের নিকট থেকে অনুমতি নিতে হয়। এই অনুমতিকে রপ্তানি লাইসেন্স বলে।
৫. মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণঃ
বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার উঠানামা প্রায়ই হয়। এরূপ উঠানামায় রপ্তানিকারক যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় এজন্য সে ব্যাংকের সাথে মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করে চুক্তি সম্পাদন করে। ফলে মুদ্রার বিনিময় হারের উঠানামা তাকে প্রভাবিত করে না।
৬. জাহাজ ভাড়া চুক্তিঃ
প্রত্যয়পত্র খোলার পর থেকেই রপ্তানিকারক জাহজ অনুসন্ধান করতে থাকে। এ পর্যায়ে সে জাহাজ কোম্পানির সাথে পণ্য-দ্রব্য প্রেরণের সকল বিষয় অর্থাৎ পণ্যের পরিমাণ, ভাড়া, বহন পদ্ধতি, বহনের তারিখ, বহন পথ ইত্যাদি চূড়ান্ত করে চুক্তিসম্পাদন করে। এই চুক্তিকে জাহাজ ভাড়া চুক্তি বা Charter Party বলা হয়।
৭. পণ্য-দ্রব্য সংগ্রহঃ
রপ্তানি বিষয়ে সরকারি অনুমতি এবং প্রত্যয়পত্র খোলার পর থেকে রপ্তানিকারক রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন বা সংগ্রহ কাজ শুরু করে থাকে। এই পর্যায়ে এসে সকল পণ্য উৎপাদন বা সংগ্রহ করে আমদানিকারকের নির্দেশ মতো পণ্যের প্যাকিং সম্পন্ন করে থাকে।
৮. পণ্য-দ্রব্যের বীমাকরণঃ
রপ্তানিকারক তার রপ্তানিযোগ্য পণ্য নিরাপদে আমদানিকারকের নিকট পৌঁছানোর জন্য নৌ-বীমা কোম্পানির সাথে বীমা চুক্তি সম্পাদন করে। বীমার প্রিমিয়াম প্রাথমিকভাবে রপ্তানিকারকই পরিশোধ করে থাকে। পরবর্তী সময়ে বিলের সাথে সে আমদানিকারকের নিকট থেকে আদায় করে নেয়।
৯. শুল্ক বিষয়ক আনুষ্ঠানিকতা পালনঃ
এই পর্যায়ের রপ্তানিকারক তার রপ্তানিযোগ্য পণ্যের বিস্তারিত বিবরণ (পণ্যের নাম, পরিমাণ, মূল্য, যে জাহাজে পণ্য যাবে, যে পথে যাবে এবং যে দেশে যাবে ইত্যাদি) উল্লেখ করে শুল্ক কর্তৃপক্ষের চালান পূরণ করে রপ্তানির ঘোষণা প্রদান করে।এজন্য তাকে নির্ধারিত ফি প্রদান করতে হয়। এই ঘোষণার সাথে সরকারের অনুমতি পত্র, প্রত্যয় পত্র, জাহাজ ভাড়ার চুক্তি ইত্যাদি প্রয়োজনীয় দলিলপত্র সংযুক্ত করতে হয়। শুল্ক কর্তৃপক্ষ এসকল দলিলপত্র নিরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হলে, রপ্তানি আদেশ ইস্যু করে এবং চালানের উপর শুল্কের পরিমাণ উল্লেখ করে দেয়।
১০. জাহাজে পণ্য-দ্রব্য বোঝাইকরণঃ
জাহাজে পণ্য বোঝাইকরণের পূর্বে রপ্তানিকারককে পণ্যের ওজন সংক্রান্ত প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করে শুল্ক বিভাগে জমা দিতেহয়, রপ্তানি শুল্ক এবং জাহাজ ঘাটের ভাড়া (Dock Charge) পরিশোধ করে জাহাজে পণ্য বোঝাইর ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হয়। এর আলোকে জাহাজে পণ্য বোঝাই করে জাহাজের ক্যাপটেন রপ্তানিকারকে কাঁচা রশিদ (Mate receipt)প্রদান করে। এই রশিদে পণ্যের বিস্তারিত বিবরণ, ওজন এবং জাহাজের স্থান কতটুকু দখল করেছে তা উল্লেখ থাকে। কাঁচা রসিদ এবং পণের চালান জাহাজ কর্তৃপক্ষের নিকট জমা দিয়ে তাদের থেকে রপ্তানিকারক তিন প্রস্থে তৈরি চালান রসিদ (Bill of Lading) গ্রহণ করে। যাতে পণ্য দ্রব্যের বিবরণ জাহাজের নাম, জাহাজ নির্দিষ্ট বন্দরে পৌঁছার সম্ভাব্য তারিখ, প্রেরক ও প্রাপকের নাম ও ঠিকানা ইত্যাদি উল্লেখ থাকে।
১১. জাহাজে পণ্য প্রেরণের সংবাদ প্রদানঃ
জাহাজে পণ্য বোঝাই শুরু করেই ইহার সংবাদ রপ্তানিকারক আমদানিকারককে প্রদান করে। উক্ত সংবাদে পণ্য-দ্রব্য বোঝাই
সংক্রান্ত তথ্য, জাহাজের নাম, জাহাজ বন্দরে পৌছার সম্ভাব্য তারিখ এবং জাহাজের যাত্রাপথ ইত্যাদি উল্লেখ থাকে।
১২. প্রয়োজনীয় দলিলপত্র তৈরি ও প্রেরণঃ
জাহাজে পণ্য প্রেরণের সংবাদ প্রেরণের পরই রপ্তানিকারক রপ্তানির প্রয়োজনীয় দলিলপত্র যেমন- চালানি রসিদ, নৌ- বীমাপত্র, রপ্তানি চালান, বিনিময় বিল, প্রভব লেখ ইত্যাদি তৈরি করে তার ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানিকারকের নিকট পাঠিয়ে দেয়। এই দলিলগুলোকে জাহাজী দলিল বা রপ্তানি দলিল বলা হয়। বিলের মুল্য বা স্বীকৃতি পেয়ে ব্যাংক এই দলিলগুলো আমদানিকারীকে প্রদান করে।
১৩. মূল্য প্রাপ্তিঃ
বিনিময় বিলে আমদানিকারকের স্বীকৃতি পাবার পর ব্যাংক তা রপ্তানিকারকের নিকট ফেরৎ পাঠায়। এই বিল ব্যাংকে জমা দিয়ে বা মেয়াদ পূর্তির পূর্বে বাট্টা করে রপ্তানিকারী অর্থ সংগ্রহ করতে পারে।
১৪. লেনদেনের পরিসমাপ্তিঃ
জাহাজ থেকে পণ্য-দ্রব্য গ্রহণের পর আমদানিকারক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে ফরমায়েশ অনুযায়ী সকল পণ্য ঠিক আছেকিনা। সব ঠিক থাকলে সন্তুষ্ট হয়ে আমদানিকারী রপ্তানিকারীকে ধন্যবাদ দিয়ে চিঠি প্রদান করে। এর মাধ্যমে লেনদেনের পরিসমাপ্তি ঘটে থাকে। তবে পণ্যের ওজন, গুণাগুণ বা কোন ত্রুটি থাকলে পারস্পারিক আলোচনা অথবা বণিক সমিতির মাধ্যমে তা মিটানো যায়।
পুনঃ রপ্তানিঃ কোন দেশ এর কোন ব্যবসায়ীর নিকট থেকে পণ্য প্রথমে আমদানি করে তা আবার তৃতীয় অন্য কোন দেশে রপ্তানি করাকে পুনঃরপ্তানি ব্যবসা বলে।
Leave a Reply